-
Posted by
Hasina Akhtar Nigar January 18, 2019 -
Filed in
Society
-
#winner
-
1,697 views
অনন্যা - তুমি অনন্যাই
-হাসিনা আকতার নিগার
জীবনের চলার পথে নানা কিছু দেখতে দেখতে এখন বড় বেশী পরিশ্রান্ত মনে হয় নিজেকে । শুধু মনে হয় কবে যে পাবো ছুটি। মানুষ বলে অতীত সুখের কিংবা দুঃখের যাই হোক না কেন তা সব সময় সময়ই কষ্টের । তবে একজন নারী যখন মা হয়ে সন্তানের দায়িত্ব পালন করে তখন তার কাছে জীবনের অতীতটা অনেক বেশী দামি হয়ে যায়। বিশেষ করে একা চলার পথে।
একজন মা যখন ছোট এক শিশুর হাত ধরে তার পৃথিবী তৈরী করতে শুরু করে তখন চলার পথে পথে তার বিধেঁ অনেক কাটাঁ। তারপর ও তাকে শিশুর মুখটি মনে করিয়ে দেয় ‘মা আমার তো কোন দোষ নেই । আমি যে বড় হতে চাই।’ আর মা তার জীবনের স্বপ্নকে দেখতে শুরু করে সন্তানকে মানুষ করার মধ্যে দিয়ে।
পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের অমতে অনন্যা ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার সাজিয়েছে ছিলো। কিন্তু নামের মতো তার জীবনটা তাকে অনন্যা করে ফেলেছে পৃথিবীতে।
নিজের মনের মতো করে ভালোবাসা দিয়ে ঘরনী হবার শখে তৈরী করলো না নিজের ক্যারিয়ার।আর এই ঘরমুখী জীবনের সে মোহের খেসারত দিয়ে যাচ্ছে অনন্যা আজ অবধি। লোকপ্রশাসন থেকে পাশ করেছিলো অনন্যা।পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ছিল পরিচিত। আধুনিক ধ্যান ধারণাতে মানুষ হয়েও সে যেন পুরোদমে এক বাঙালী নারী। সাজাতে ভালোবাসা বাঙালী নারীর আদলে। কপালে টিপ পরনে ঢাকাই শাড়ী আর এলো খোঁপাতে বাহারী খোপার কাটাঁ ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাজ। যা দেখে তাকে ভালোবেসে ছিলো জয়।
তবে বিয়ের তিন বছরের মাথায় জয়ের চিন্তা বদলে যেতে থাকে। অনন্যাকে তার আটপৌরে মনে হতো। এর জন্য অনেকটাই অনন্যা এখন নিজেকে দায়ী মনে করে।
অতি সাধারন জয়কে অনন্যা তার আধুনিক পরিবেশ অভ্যস্ত করতে গিয়ে সে নিজেই সেকেলে হয়ে গেলো।
আর তাই এখন নিজের বুকের ভিতরে ছাই চাপা আগুন নিয়ে বসবাস তার । কাউকে কিছু বলার নাই। জয় সব সময় নানাভাবে চেষ্টা করে অনন্যার বাবার সম্পত্তি তার নামে করে নিতে। বাবা মা প্রথমে আপত্তি করলেও আদুরে মেয়েকে বেশী দিন দূরে রাখতে পারেনি। আর মেয়ের আয়েশী জীবনকে ঠিক রাখতে প্রতি মাসে টাকা দিতো বাবা মা আলাদা করে। মা বাবার এই কেয়ারিংটাই অনন্যাকে চিনিয়ে দেয় আসল জয়কে।
এর মধ্যেই তাদের সংসারে আসে ছোট শিশু অনামিকা। এবার যেন অন্য এক সংগ্রামের পথে পা বাড়ালো অনন্যা। জয় তার ঔদ্ধত্য আচরণ দিয়ে অনন্যাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতে শুরু করলো। আর এ নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ যে তার নিজের আত্মসম্মান বোধকে আঘাত করে। মা বাবাকে কিছু বলতে পারে না অনন্যা । কারন তারা মেয়ের জন্য তাদের সব কিছু দিতে রাজী। আর এটা হতে দিবে না অনন্যা । তাই সে অনেকটাই দূরে থাকে মা বাবা থেকে।
অনামিকা যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করছে তখন অনন্যা সিদ্ধান্ত নিলো আর যাই হোক বিশ্বাস সম্মান ছাড়া যেমন ভালোবাসা হয় না তেমনি ভালোবাসার নাটক করে সে তার সন্তানকে বড় করবে না। কারন জয় তার জীবনে আর একজনকে নিয়ে সংসার করার চিন্তার চূড়ান্ত পরিনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই অনন্যা আর পারলো না সংসারের মিছে মোহতে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে। অনেক হয়েছে। এবার নিজেকে নিজের পরিচয় তৈরী করতে হবে । একা পথ চলে মেয়েকে শিখাবে জীবনের সত্যিকারের অর্থ।
ঘর ছাড়ে অনন্যা নিজের কিছু জমানো টাকা নিয়ে । নিজের মতো করে আবার সাজায় মা - মেয়ের সংসার। নিজের বন্ধু – বান্ধবদের সাথে যোগা যোগ করলো।কিন্তু তারা কাজের আলাপের চেয়ে তার জীবনের চুলচেরা বিশ্লেষন করে বুকের ঘা টাকে আরো বাড়িয়ে দিতে শুরু করলো ।
সবার থেকে দূরে সরেই লড়াইটা শুরু করে অনন্যা ছোট একটা চাকরি দিয়ে। আর মেয়ে অনামিকা মাকে দেখে ছোট বেলাতেই বুঝে গেছে তাদের জীবনটা আলাদা। মা তাকে কোন সত্য আড়াল করে না। তাই সব সময় মায়ের স্বপ্ন পূরন করার জন্য চেষ্টা করেছে সেটাই । আর অনন্যা মনে মনে বিধাতাকে বলে, 'তুমি যা নিয়েছ তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছ আমাকে অনামিকার মা করে। '
সাংস্কৃতিক জগতের অনন্যা এখন পুরোদস্তুরে এক চাকুরীজীবি নারী। অফিসের প্রজেক্ট আর মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত রাত দিন। জয় তাদের জীবনে হারানো অতীত। তবে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট লাগে মেয়েটাকে সময় দিতে পারে না বলে। অনামিকা মায়ের এ অনুতাপে হেসে বলে -
আচ্ছা মা, তুমি যদি আমাকে সময় দিতে তাহলে কেমন করে চলত সংসার আর আমার পড়ালেখা। অনন্যা নীরবে চোখের জল ফেলে মেয়ের কথাতে।
সময়ের সাথে সাথে কবে যে অনামিকা মা আর অনন্যা মেয়ে হয়ে গেছে টেরই পাইনি তারা। আজকাল অনামিকার চিন্তা হয় মায়ের জন্য। ছোট অনামিকা সিএ করে বেশ বড় কোম্পানিতে চাকরী করছে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছে কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকাটা। আজ তার যা কিছু অর্জন তার সবটাই মায়ের আত্মবলিদান। একদিন যারা মাকে এড়িয়ে যেত আজ তারা প্রতিষ্ঠিত অনন্যার নাম বলতেই অজ্ঞান। কিন্তু এ মা যে তার জন্যই নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
ওকে ছাড়া মায়ের যে কেউ নেই। তাহলে কেন মা তার বিয়ে দিতে অস্থির হলো। অমিত মাকে বলেছিল, মা থাকবে তাদের সাথে। কিন্তু মা রাজি হলো না। শুধু হেসে বলেছিল - পাগল, তোদের কি মনে হয় আমি একা চলতে পারি না।
অনন্যা বারান্দায় বসে ভাবছে একদিন পর এ ঘরে সে একা হয়ে যাবে। অনামিকা বউ সাজিয়ে তুলে দিবে অমিতের হাতে। এটাই যে মা হিসাবে শেষ দায়িত্ব তার। কোথাও থেকে একটা কষ্ট বুকে বড় বিঁধছে আজ। কই এমন করে তো নিজেকে আর কোনদিন একা লাগেনি। তাহলে আজ কি সে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে?
অনামিকা চুপিচুপি মায়ের কাছে এসে বসে। অনন্যা মেয়ের হাতের ছোঁয়ায় পেয়ে বলে -
কি রে টেনশন হচ্ছে বুঝি নতুন জীবন নিয়ে। আমার সাহসী মেয়েটা কবে ভীতু হলো এমন।
অনামিকা বলে - মা, তোমার মেয়ে কি করে ভীতু হবে? একটা কথা বলবে আমায়?
অনন্যা দেখে মেয়ের চোখে জল টলমল করছে আর বুঝে কি বলবে। তাই একটু ধমকের সুরেই বলে - তোমাকে বলেছি তোমার মাঝেই আমি বেঁচে আছি অনামিকা।আর কিছু নেই আমার।
এটা শুনে অনামিকা নিজেকে শক্ত করে বলে - জানি মা। তুমি তোমার নামের মতই অনন্যা। তোমার মেয়ে হতে পারাটা আমার জন্য চরম পাওয়া।
মা তবু একটা প্রশ্ন - কেন তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবলে না? আমাকে বলেছ মানুষ সাথী ছাড়া একা থাকতে পারে না। তাহলে তুমি কি করে পারলে?
অনন্যা কোন উত্তর দিতে পারেনি। শুধু অনামিকার কপালে আদর দিয়ে বলে - কবে বড় হবি রে তুই?