নারী দিবস

  • নারী দিবসের অন্তরালের কথা
    হাসিনা আকতার নিগার

    বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করবে আগামী ৮মার্চ। আলোচনাসভা, র‌্যালি, প্রদর্শনী এবং নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিবসটি পালিত হবে। সংবাদপত্রগুলো এই দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে এবং টেলিভিশন ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে।

    নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এ দিবসটকে ঘিরে রয়েছে এক প্রতিবাদের ইতিহাস।

    মানব সভ্যতার ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আহ্বান এক কালজয়ী ঘটনা। এ সময় রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র ভেঙে দর্শন চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় বিশাল আলোড়নের। দার্শনিক জ্যা জ্যাঁক রুশোর ঐতিহাসিক মন্তব্য, ‘মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু পরে তাকে সর্বত্রই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয়’। এই উক্তি মধ্যযুগীয় সমাজে শৃঙ্খল ভাঙ্গার এক নতুন তরঙ্গের সৃষ্টি করে। এই বিপ্লবের মূল বাণী, ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’র ঘোষণা আসে ‘RIGHTS OF MEN’ শিরোনামে। তখনই মহীয়সী অল্যাম্প দ্য গুজে -এর প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেন, ‘RIGHTS OF WOMEN’ নয় কেন? এমনি এক প্রতিবাদ আর প্রতিরোধর মধ্যদিয়ে সূচিত হয়, নারী অধিকার আন্দোলনের।

    শ্রেণীগতভাবে সমাজে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের বিভাজন থাকলেও নারীর অধিকারের প্রশ্নে বাস্তবে কোন বিভাজন নেই। দেশে দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে; কিন্তু ভিন্নতা নেই নারীর প্রতি বৈষম্যের ক্ষেত্রে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারীসমাজের আন্দোলন অব্যাহতভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে যুগে তাবৎ যুগে এবং ক্রমান্বয়ে তা আরো শক্তিশালী ও ব্যাপক আকার ধারন করছে।

    ঊনবিংশ শতকে পশ্চিমা বিশ্বে শিল্পের ব্যাপক বিকাশের ফলে কলকারখানায় নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ শতকের শুরু থেকে মূলত কাজের পরিবেশ, শ্রমের সমমজুরি, ভোটের অধিকার ইত্যাদি দাবি নিয়ে নারীর অধিকার আদায়ে সংগ্রাম বিকশিত হয়। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে ১৫ হাজার নারী শ্রমিক কাজের ঘণ্টা কমানো, যথাযথ মজুরি এবং ভোটের দাবিতে মিছিল করে। এই প্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সোস্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এই দিবসটি ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার উদ্যাপন করা হতো।

    এই পটভূমিকায়, ১৯১০ সালে কর্মজীবী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। সম্মেলনে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী এবং জার্মানির সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কর্মী ক্লারা জেটকিন ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদ্যাপনের ধারণাটি উত্থাপন করে প্রস্তাব করেন, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বছরে একটি দিন নারী দিবস হিসেবে বিশ্বের প্রতিটি দেশ উদযাপন করবে। ১৭টি দেশের সোস্যালিস্ট পার্টি, ইউনিয়ন, কর্মজীবী নারী সমিতির প্রায় ১০০ নারী নেত্রীর অংশগ্রহণে এই সম্মেলন থেকেই নারীদের জন্য একটি বিশেষ দিন হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের সূচনা ঘটে।

    ১৯১১ সালে ১৯ মার্চ সর্বপ্রথম ‘আন্তর্জতিক নারী দিবস’ পালন করে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড। নারীর কাজের অধিকার, ভোটের অধিকার এবং বৈষম্য দূরীকরণের দাবি নিয়ে প্রায় দশ লক্ষ নারী সম্মিলিতভাবে প্রথম এই দিবসটি পালিত হয়। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯ মার্চের পরিবর্তে ৮ মার্চ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হয়: ৮ মার্চ হচ্ছে জাতিসংঘের একটি বিশেষ দিন যা, নারীর অধিকার এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের ঐতিহাসিক এবং জাতীয় ঐতিহ্য অনুসারে পালন করবে।

    নারীদের জন্য একটি বিশেষ দিন নির্ধারণের যুক্তি হিসেবে জাতিসংঘ মনে করে, শান্তি ও সামাজিক প্রগতি নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগের জন্য প্রয়োজন সমতা ও উন্নয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। সিদ্ধান্ত হয়, এই দিনে জাতিসংঘের মহাসচিব বাণী প্রদান করবেন।

    বর্তমানে এই দিবসটি একটি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। চীন, রাশিয়া, আজারবাইজান, বেলারুস, বুলগেরিয়া, জাম্বিয়া, কাজাখস্তান, খিরগিস্তান, মেসিডোনিয়া, মলডোবা, মঙ্গোলিয়া, তাজিকিস্তান, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ভিয়েতনামসহ বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশ দিবসটি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই দিনটিতে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নারী সদস্যদের ফুল ও নানা সামগ্রী উপহার দেন। অন্যান্য দেশে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়।

    আবার এ উপমহাদেশে উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের সাথে জড়িত এখানকার নারী আন্দোলনের ইতিহাস। বাঙালির নবজাগরণ, সমাজ সংস্কার, ব্যক্তির অধিকার তথা ব্যক্তিসত্তা বিকাশের প্রয়োজনীয়তা থেকেই সূচনা ঘটে নারী আন্দোলনের। একই সময়ে বিশ্বযুদ্ধ, কৃত্রিম অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় গড়ে উঠে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। এছাড়া সখী সমিতি, রাখী বন্ধন এসবের মধ্যদিয়ে সূচিত হয় নারীর চেতনা বৃদ্ধির আন্দোলনের।

    বাংলাদেশে ১৯৫২ থেকে ’৭১ পর্যন্ত নানা স্তরে পাকিস্তানী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিকাশের আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও মানবিক চেতনার বিকাশ এবং প্রাসঙ্গিক দাবিতে বাংলার নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য ।

    বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয় ষাটের দশকের শেষের দিকে, সীমিত আকারে ও গোপনে। পূর্বপাকিস্তানে তৎকালে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে সংগঠনের নারী সদস্যদের নিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। আর পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের (বর্তমানের মহিলা পরিষদ) উদ্যোগে ‘নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে’ ১৯৬৯ সালে প্রকাশ্যে সর্বপ্রথম দিবসটি পালিত হয়। সেদিন পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক অধিকার ও ১১ দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামের প্রতি নারীদের সমর্থন ঘোষণা করা হয়। এছাড়া জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের এক-ষষ্ঠাংশ আসন নারীদের জন্য বরাদ্দের দাবিসহ নারীদের চাকরির সুব্যবস্থা, সামরিক শিক্ষাদান, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণ, রেশনে পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ প্রভৃতি দাবি জানানো হয়। ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বিশ্ব নারীসমাজের সাথে একত্মতা ঘোষণাসহ বিভিন্ন দেশে অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত নারীসমাজের প্রতি অভিনন্দন জানানো হয়। একই সাথে চিলির সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের স্মরণ করা হয় এবং দেশে দেশে নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।

    ১৯৭৫ সালে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে মহিলা পরিষদ। এই লক্ষ্যে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ জাতীয় প্রস্তুতি কমিটি’ গঠিত হয়। সেই থেকে দেশের সকল নারী সংগঠনগুলো একত্রে রাজধানীতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়াও প্রতিটি জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করে আসছে। সাধারনত সমাবেশ, মিছিল, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাসহ গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রচারমূলক কর্মসূচি, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বিশেষ সংখ্যা, পোস্টার, লিফলেট প্রকাশ করা হয়। ‘বাংলাদেশে নারীরা রাতেও নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন’ এই অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপক হিসেবে গতকিছু বছর ধরে নারী সংগঠনগুলো মিলে ৮ মার্চ রাত ১২ টায় জাতীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের নারীদের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এখানে অনেক পুরুষও অংশগ্রহণ করেন।

    এইভাবে নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে নারী পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি প্রগতিশীল ও উন্নত সমাজ গঠনের লক্ষ্যেই প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন হয়ে আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের নারীসমাজ যত অধিক সংখ্যায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন তত বেশি তাৎপর্যময় হয়ে উঠছে।

Comments

2 comments