বৈশাখ ফিরে আসুক আদি রূপে


  • লাল চুড়ি সাদা শাড়ীর বৈশাখী আসুক ফিরে
    -হাসিনা আকতার নিগার
    পরনে লাল পাড়ে সাদা শাড়ী হাতর্ভতি লাল রেশমী চুড়ি, কপালে লাল টিপ এমন সাজে বৈশাখী মেলাতে বেড়ানোর এক কল্পনার ছবি আকেঁ অজান্তা। এমন বৈশাখ তার জীবনে কোনদিন আসবে কিনা জানা নেই যদিও তার।

    তবে প্রতিবারই বসন্ত যখন যাই যাই করে আর সারা দেশ জুড়ে বৈশাখী আয়োজন শুরু হয় তখনি অজান্তার মনের কোনে কল্পনাটা আবার নড়ে চড়ে বসে। অপেক্ষা করে আপন মানুষটির সাথে যদি এমন একটা দিন পেত তবে মেলা থেকে রংবেরং এর চুড়ি আর কত কি কিনত । কিন্তু এবারও এলো না সেদিনটি। দূরের মানুষটি দূরেই রইল।আবার আগামী বৈশাখের অপেক্ষার পালা শুরু। হয়ত অপেক্ষাই জীবনের আর এক নাম।

    ‘অপেক্ষা’- শব্দটি মনে হতেই অজান্তার মনে পড়ে যায় বিগত দিনের বৈশাখী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনার কথা। বোম হামলা, নারীদের হয়রানী করা, তথাকথিক ধর্মের নামে নানা অপ্রচার। সব কিছু মিলে কেমন জানি একটা শংকা এবারের বৈশাখেও মনে দানা বেঁধে উঠে। ১৪২২ সালের বর্ষবরনে নারীদের নির্যাতনের ঘটনা দিয়ে এমন শংকার সূচনা হয়েছে । আর যারা এটা ঘটিয়েছে আজ তার কিছুটা হলেও সার্থক । কারন দেশের সংস্কৃতির পথে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পেরেছে আংশিকভাবে।

    তবে ধর্ম আর সংস্কৃতিকে এক করে বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে নষ্ট করা বন্ধ করতে হলে অবশ্যই কর্পোরেট দুনিয়ার উৎসবে গা না ভাসিয়ে ফিরে যেতে হবে গ্রাম বাংলার ইতিহাসের কাছে । তবেই আগামী প্রজন্ম জানাবে বাংলার বৈশাখ কিংবা বর্ষবরনকে। হয়ত বা এর জন্যও অপেক্ষা করতে হবে বাংলার মানুষকে । তার একটি প্রমান হলো পান্তার সাথে ইলিশ বর্জন গত বৈশাখী আয়োজনে।

    পান্তা ভাত পেয়াজ আর কাঁচামরিচ গ্রাম বাংলার অতি সাধারন কৃষকের নিত্য দিনের খাবার। আজ তা কর্পোরেট কালচারে ডাইনিং টেবিলে মাটির থালাতে সাজিয়ে দামী ইলিশ মাছ সহ পরিবেশন হয় বছরের একটি দিনে।আর সে কারনে বাড়ছে ইলিশের দাম। যদিও বিক্রিত ইলিশ গুলো মৌসুমের সময় সংরক্ষন করা হয়েছে বৈশাখকে চিন্তা করে।

    মূলত চৈত্র সংক্রান্তি এবং বাংলা বছরের শুরুতে হাট বাজারে ব্যবসায়ীরা হাল খাতার আয়োজন করে। পুরান হিসাব শেষ করে খুলে নতুন হিসাবের খাতা । দোকানে আপ্যায়ন করা হয়ে মিষ্টি দিয়ে। অন্য ভাবে হিন্দু ধর্ম অনুসারীরা তাদের সনাতনী রীতি নীতি মেনে পূজা অর্চনা করে এবং নিয়ম অনুযায়ী খাবারের আয়োজন করে । একই ভাবে পাহাড়ের আদি জনগোষ্ঠী পালন করে বিজু উৎসব। গ্রাম বাংলার কৃষকের জীবনে ফসলের চাষাবাদের হিসাব হয় বাংলা মাস দিয়ে । আর দেখা যায় যে ঋতু ভিত্তিক গ্রাম বাংলায় ১লা বৈশাখের দিনটিতে সকলই সারা বছরের মঙ্গল কামনায় কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করে। এই যেমন বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা জাতীয় বা নিরামিষ খাবার খেলে শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ১ লা বৈশাখে একটু ভালো খাবারের আয়োজন উৎসব বলে বা সকাল বেলা দই চিড়া।

    কিন্তু এসব আচার অনুষ্ঠান আর কৃষকের বাংলাকে ভুলে গিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়াতে আজকাল নতুন কাপড় কেনা কাটা , উপহার আদান প্রদান কোন বর্ষবরনকে তুলে ধরে তা বোধগম্য নয়। দেশের শহুরের মানুষদের জীবনে বাংলা মাসের হিসাব কোনদিনই থাকে না বিশেষ কিছু দিন ছাড়া। সারা বিশ্ব জুড়ে পশ্চিমাদের বেনিয়া হিসাবের নানা দিবসের গড্ডালিকা প্রবাহে বাংলার কৃষ্টি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চর্যাপদ, গীতিকাব্য সহ নানা কিছু। ছায়ানট আর চারুকলার বর্ষবরনের আয়োজন দেখে একটা সময় আশা ছিলো অত্যন্ত শহরের জীবনে অভ্যস্ত আগামী প্রজন্ম গ্রাম বাংলার কথা জানবে এ সব আয়োজনের মাধ্যমে। কিন্ত না কালের প্রবাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসব বাধা গ্রস্থ হচ্ছে নানাভাবে।

    নিজেদের কৃষ্টি সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়ে শুধু মাত্র বাহারী সাজে উৎসব পালনের আন ন্দ টুকু ম্লান হয়ে যায় অপশক্তির কোন অপকর্মে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ীটিকে শোকের কিংবার বেদনার কালো রংয়ে ধারন অজান্তার করতে মন চায় না ।

    তার শুধু মনে হলো কোন উৎসবকে রাজনীতি , ধর্ম বা বেনিয়ার হাতে তুলে না দিয়ে আমরা কি ফিরে যেতে পারি না বাংলার রবীন্দ্রনাথ , নজরুল কিংবা মুধুসুদনের কাছে। যদি এমন দিন আসে তবেই সেদিন প্রিয় মানুষটির সাথে লাল পাড়ে সাদা শাড়ীর সাজে কোন গ্রামের বৈশাখী মেলাতে গিয়ে কিনে আনবে লাল- সাদা - নীল রংয়ের কাচেঁর রেশমী চুড়ি।