Posted by
Hasina Akhtar Nigar April 1, 2019 -
Filed in
Other
-
## tread
-
1,813 views
বিশ্ব অস্ত্রবাণিজ্যের নানা কথা
হাসিনা আকতার নিগার
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের হাতে অস্ত্র ছিল। কালের বিবর্তনে এবং প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে সেই অস্ত্র এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আত্মরক্ষার অস্ত্র এখন পরিনত হয়েছে মারণাস্ত্রে। বর্তমানে পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৮০ লাখ বন্দুক তৈরি করা হয়। প্রাচীনকালে যেমন প্রস্তরখন্ড সুলভ ছিল এখন অস্ত্র সুলভ। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি এক মিনিটে একজন আগ্নেয়াস্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছে।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে (১৯৯০ সালে শেষ হওয়া) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই অস্ত্র রপ্তানিকে অন্য দেশের ওপর, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব অস্ত্রবাণিজ্যে কিছুটা ধস নামে। তবে ২০০৩ সাল থেকে আবারো অস্ত্রবাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। আর এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বেশি। সেই ধারাবাহিকতায় আবারো পৃথিবী স্নায়ুযুদ্ধের কাছাকাছি চলে এসেছে।
কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট অস্কার অরিয়াস স্যানচেজ বলেছিলেন, ‘যখন একটি দেশ শিক্ষা, গৃহায়ন, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ না করে অস্ত্র ক্রয়ে মনোযোগী হয় তখন পুরো একটি জাতির উন্নয়ন ও সুখকে উপেক্ষা করা হয়। আমরা প্রতি ১০ জনের জন্য একটি অস্ত্র তৈরি করতে পারছি কিন্তু পৃথিবী থেকে দারিদ্র দূর করার কথা ভাবছি না।’ ১৯৮৭ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী অস্কার অরিয়াস স্যানচেজের কথা এখনো সমানভাবে সত্য। জাতিসংঘ চিৎকার করে অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের কথা বলছে, কিন্তু জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সে কথায় কান দিচ্ছে না।
কেউ অস্ত্র উৎপাদন করছে, কেউ কিনছে। আর স্বৈরশাসক, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা সে সকল অস্ত্রের আঘাত থেকে সাধারণ জনগণও রেহাই পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির মেরুকরণও নির্ভর করে বিশাল অস্ত্রবাণিজ্যের ওপর। একশ্রেণী অস্ত্র বিক্রির জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে, আরেক শ্রেণী অস্ত্রের জোরেই দুর্বল জাতির ওপর পেষণ চালায়। অর্থাৎ কেউ অস্ত্র বিক্রির উপায় হিসাবে পৃথিবীতে অস্থিরতা আরোপ করে, কেউ অস্ত্রের অহংকারে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে। আর এটা প্রমাণিত যে সামরিক বাহিনী, বাণিজ্য ও রাজনীতি একে অন্যের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। অস্ত্রের ইস্যুতেই বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ভন্ডামিও চোখে পড়ার মত, যেমন-চীন। সে বন্যায় পাকিস্তানে ত্রাণ দেয়, আবার একই সঙ্গে নিজের অস্ত্র ক্রেতা পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পাক-ভারত সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে চায়। সমস্যা না থাকলে পাকিস্তান বা ভারত কেন অস্ত্র কিনতে যাবে?
পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগ অস্ত্র ব্যবসাই বৈধ। আর পৃথিবীর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অস্ত্রের মাত্র ১২ শতাংশ নিবন্ধিত। বৈধ-অবৈধ উভয় ব্যবসাই সগৌরবে চলছে কেননা বিশ্বমোড়লরাই অস্ত্রের প্রধান ব্যবসায়ী। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব অঞ্চলের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল সে সব অঞ্চলেই অস্ত্রের অবাধ বিচরণ এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সে সব অঞ্চলকেই নিজেদের বড় বাজার হিসাবে গণ্য করে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়া। দেখা গেছে বছরে ৬০ বিলিয়ন বন্দুক প্রবেশ করে ভারত পাকিস্তানে।
অস্ত্র ক্রয়ের দিক থেকে শীর্ষে আছে সৌদি আরব। এরপর রয়েছে যথাক্রমে , ভারত, সংযুক্ত আবর আমিরাত, মিশর, ভেনিজুয়েলা, পাকিস্তান , চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল , ইরাক এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ। সৌদি আরব ও ভারত ১৯৯০ সাল থেকেই অস্ত্র ক্রয়ের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। আর দিন দিন তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর জন্য অস্ত্র কেনা অনেকটা সহজ হয়েছে।
‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৯ সালে অস্ত্র রপ্তানিকারক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্থানে ছিল। তারপর যথাক্রমে রাশিয়া, জার্মানী, ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেন, চীন, ইসরায়েল, নেদারল্যান্ড, ইতালি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ইউক্রেন, কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়া।
বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৬শ ৩৯ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, যার ৫৯ শতাংশের বৈধ মালিক সাধারণ জনগণ। ক্রেতা হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় বাজার। মার্কিন নাগরিকদের হাতে প্রায় ২শ ৭০ মিলিয়ন বন্দুক রয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ১শ জনের জন্য ৯০টি বন্দুক। পৃথিবীতে প্রতিবছর যে ৮০ বন্দুক উৎপাদন হয় তার ৪৫ লাখ কেনে আমেরিকানরা। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রধারী নাগরিক বসবাস করে।
২০০৮ সালে ব্রিটেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র উৎপাদক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের ‘বিএই সিস্টেমস’ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের প্রথম কোম্পানি যা পেন্টাগনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে সক্ষম হয়েছিল। বিইএ মার্কিন বাহিনীর জন্য স্থলমাইন প্রতিরোধক ট্যাঙ্ক বানানোর কাজ করেছে। মার্কিন সামরিক বিভাগ বিশেষ এই ট্যাঙ্কগুলো ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ ব্যবহার করেছে। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ জানিয়েছে, সে সময় বিএই কর্তৃক উৎপাদিত অস্ত্রের ৬১.৫ শতাংশই বের হত কোম্পানিটির যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত কারখানা থেকে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন প্রায় ১শটি দেশে ছোট অন্ত্র রপ্তানি করেছে বলে জানিয়েছে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এক বা একাধিক অস্ত্র উৎপাদক করপোরেশন থাকে। বিশ্বের প্রধান অস্ত্র উৎপাদনকারী কয়েকটি করপোরেশনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- ফ্যাব্রিকেশনস মিলিতারিস, ফাব্রিকা মিলিতার এইভিয়ান্স (আর্জেন্টিনা), গলোক, অস্ট্রেলিয়ান সাবমেরিন করপোরেশন (অস্ট্রেলিয়া), ডিফেন্স অ্যাডভান্সমেন্ট ট্রেডিং কোম্পানি (বাংলাদেশ), ফ্যাব্রিক ন্যাশনাল দি হার্স্টল বেলজিয়াম), স্পার এ্যারোস্পেস (কানাডা), চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার (চীন), স্ক্যান্দিনাভিস্ক এ্যারো ইন্ডাস্ট্রি, টার্মা (ডেনমার্ক), এওআই (মিশর), ইএডিএস, ড্যাসল্ট এভিয়েশন, ডিসিএনএস (ফ্রান্স), কার্ল ওয়াল্টার জিএমবিএইচ স্পোর্টওয়াফেন, ডিয়েল ডিফেন্স (জার্মানী), ইএএস, এইচএআই (গিস), ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, ভারত ডায়নামিকস (ভারত), পেরিন্ডাস্ট্রিয়ান অ্যানকাতন দারাত (ইন্দোনেশিয়া), ইরান এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ অর্গানাইজেশন (ইরান), এ্যারোনটিক্স ডিপেন্স সিস্টেমস লিমিটেড, অ্যাস্ট্রোনটিক্স সিএ লিমিটেড (ইসরায়েল), ফিনম্যাকানিকা (ইতালি), ডিজিআইএম (মেক্সিকো), রিলায়েবল টেকনোলজি লিমিটেড (মায়ানমার), নর্ডিক অ্যামিউনিশন গ্রুপ ( নরওয়ে), পাকিস্তান এ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স, হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ টেক্সিলা (পাকিস্তান), আইএনডিইপি (পর্তুগাল), মস্কো ইনস্টিটিউট অব থার্মাল টেকনোলজি (রাশিয়া), জাস্তাভা আর্মস, ড্যানেল (দক্ষিণ আফ্রিকা), দাইউ (দক্ষিণ কোরিয়া), এয়ারবাস মিলিটারি স্পেন), সাব (সুইডেন), থাইল্যান্ড এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ (থাইল্যান্ড), এমবিডিএ. রোলস-রয়েস (ব্রিটেন), ইউনাইটেড টেকনোলজিস (যুক্তরাষ্ট্র)। এগুলোর মধ্যে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো তাদের নিজের দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য অস্ত্র তৈরি করে। কিছু কোম্পানি নিজের দেশের মানুষের কাছে বৈধ কিংবা অবৈধ ভাবে অস্ত্র বিক্রি করে।