captain uncle and x mass day


  • বড়দিন আসে কিন্তু ক্যাপ্টেন আংকেল আসে না

    হাসিনা আকতার নিগার



    বড়দিন এলে আমার এক আংকেলের কথা খুব মনে পড়ে । আমাদের চিটাগাং এর বেশীর ভাগ মানুষ শিপিং ব্যবসা বা কাজ করে । যারা জাহাজে থাকে তাদের জাহাজী বলে । আমরা সে আংকেলকে বলতাম ক্যাপ্টন আংকেল । কিন্তু তিনি বেশ রহস্যময় ছিলেন । আমাদের এরিয়াতে সবাই ছিলো শিপিংয়ের । আংকেল জাহাজ থেকে হরেক রকমের চকলেট আনত। প্রতিদিন সবার জন্য চকলেট থাকত উনার কাছে । তিনি দেশে এলে আমাদের কলোনীর সব মাদের ভরসা ছিলো আংকেল । তার কাছে আমাদের রেখে নানা কাজে বাইরে যেতেন । আর আমরা সারদিন অপেক্ষা করতাম কখন বিকাল হবে কখন আংকেলের সাথে খেলবো । কলোনী টা অনেক সুন্দর ছিলো , চারদিকে মেহেদী গাছ দিয়ে ঘেরা । এত মেহেদী গাছ মনে হয় সে কলোনী ছাড়া আর কোথা ও ছিলো না। শুধু দুষ্টামি করলে বলত 'বড় দিনে যার যা ইচ্ছা তা পাবেনা। কিন্তু আমরা জানতাম আংকেল ঠিক দিবে ।'

    এক বড় দিনে আংকেল আমাদের যেমন আনন্দ দিলো তেমন কষ্ট । সে বার আংকেল সারা কলোনী সাজালো লাল নীল বাতি দিয়ে। আমরা ২০/ ২৫ জন ছিলাম বাচ্চা বাহিনী। সে কি অপেক্ষা আমাদের ।রাতে সান্তাক্লস আমাদের গিফট দিবে । সে বার হলো কি আংকেলের দেয়া একটা ডল আমার এক বান্ধবী নষ্ট করাতে আমি অনেক মন খারাপ করে তার সাথে কথা বলতাম না ।আংকেল আমাদের ভাব করে দিয়ে বলেছিলো ' আম্মাজান তোমার ডল আবার আসবে গড এর কাজ থেকে । '

    তারপর যে এমন কিছু হবে তা সেই বয়সে ভাবতে পারিনি । তবে আংকেল একা থাকত। আর কেউ যদি তার নিজের পরিবারের কথা জানতে চাইতো তিনি ক্ষেপে যেতো, কারো সাথে আর কথা বলতো না । উনি জাহাজ থেকে ফিরে এসে আমাদের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন খাবার খাওয়াতেন । বড়দিনে আংকেল অনেক কিছু করলেন । আমাদের মা - বাবারা অবাক তার পাগলামি দেখে ।

    রাত ১২ টা । সেবার শীত ছিলো অনেক। আমরা মজা করে যখন ঘরে ফিরবো তখন আংকেল বল লো 'চলো আমি সবার বাসাতে সবাইকে দিয়ে আসি । পরের বড়দিনে কে কই থাকি , জাহাজিদের জীবন । ' আমরা ও খুশিতে আটখানা হলাম আংকেলকে নিয়ে কলোনি ঘুরার সুযোগ পেয়ে ।

    আমার বাসা ছিলো কলোনীর শেষ দিকে আর আংকলের বাসার কাছা কাছি। সবাইকে যার যার বাসায় দিয়ে এসে আংকেল আমাদের ওখানে এসে আম্মাকে বলল চা খাওয়াতে । আম্মা চা করতে গেলো আর সে ফাঁকে আমি দেখলাম আংকেল আব্বার হাত ধরে কাঁদছে । পরে আম্মা জানতে চাইলে আব্বা বলল, কিছু না মন খারাপ। আব্বা কিন্তু কম কথা বলতেন ।আব্বাকে চিন্তিত মনে হলো।

    ডলকে ফিরে পাবার আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম আমি । কিন্তু জানতাম না সকাল টা আমাদের এমন নিকেষ কালো হবে । মেহেদী পাতা ঘেরা কলোনীর মানুষগুলো ধবধবে সাদা চুলের আংকেলের হাসি মাখা মুখটির আড়ালের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরন দেখেনি কোনদিন । সেই কুয়াশা ঢাকা সকালে আম্মা খেয়াল করলো আংকেল আজ হাঁটতে বের হয়নি । তিনি হাঁটা শেষে আমাকে ডাকতেন । সেদিন 'আম্মাজান ' ডাক শুনতে না পেয়ে আম্মা শঙ্কিত হলেন । তাই একটু সময় অপেক্ষা করে গেলেন আংকেলের বাসাতে

    আম্মা দরজাতে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেলো । প্রথমে আম্মা ভাবল দরজা খোলা রেখে আংকেল কোথাও আছে। কিন্তু ঘরে সকালের গান ও বাজে না দেখে সন্দেহ হলো । আর ঘরে ঢুকে আম্মার আর্ত চিৎকারে যেন সারা কলোনী কেঁপে উঠলো। সবাই ছুটে গেলাম আংকেলের ঘরে ।

    আমরা বাচ্চাবাহিনি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । শুধু দেখছি সারা ঘ র সাজানো টিমটিম আলো জ্বলছে আর আংকেল হাসি মুখে বিছানাতে ঘুমাচ্ছে । আমার বান্ধবী রওনক বলো তুই আংকেলের আম্মাজান তুই ঘুম থেকে তুলে দেয় আংকেলকে ।

    আমি বিছানার কাছে যেতে চাইলে কলোনির ডাক্তার আংকেল বললেন সব বাচ্চাদের সরিয়ে দিতে । আমরা আমাদের প্রিয় আম গাছ তলাতে অপেক্ষা করতে থাকলাম আংকেলের জন্য।

    ভাবলাম কালকে অনেক কাজ করে হয়ত অসুস্থ আংকেল । কিন্তু না জীবনে প্রথমবার আমি হারালাম আমার এক প্রিয় মানুষকে । তখন গডকে বললাম ' আমি আমার ডল দিয়ে দিবো তুমি আমার আংকেল কে দাও। আমার ডল লাগবে না। '

    এখন আমি নিজে সন্তানের মা কিন্তু আংকেলের সেই 'আম্মাজান ' ডাক টি আজো কানে বাজে আমার । মাঝে মাঝে মনে হয় ক্যাপ্টেন আংকেল থাকলে আমি মন খারপ হলে চলে যেতাম তার কাছে ।

    আংকেল জীবনের ওপারে চলে যাবার পর আমার চলে আসি নিজেদের বাড়ীতে কিন্তু সেই থেকে আমি আর যাই না মেহেদী গাছে ঘেরা কলোনিতে । তবে একটা বিষয় আজো ভাবি জীবনের শেষ দিনে ও কেন কেউ এলো না আংকেলের আপনজনরা।নাকি সত্যি তিনি সাগরে ভাসা এক একাকী নাবিক। আজো জানি না আংকেল কেন অভিমান করে চলে গেলো ।

    বড়দিনে এলেই এখনও আমি বলি -

    আমার ডলকে ফিরিয়ে দিয়ে আংকেল যেমন বলেছে, দেখো তোমার ডল ফিরে এসেছে। তেমনি করে যদি আংকেল এসে বলতো -' আম্মাজান দেখো গড আমাকে পাঠিয়েছে তোমার কাছে । '