রাই কান্না নয়

  • তুমি কেন কাঁদলে?
    হাসিনা আকতার নিগার

    যে বোবা কান্নাতে ঘুমহীন রাত কাটে আজ সে কান্না কোন বাঁধা মানতে চাইছে না। রাই মনের ডায়রীটা কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেনি।না আজ সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাছে নিজে যেন পরাজিত। কতটা জীবন যুদ্ধ তার করতে হয়েছে সে কথা কেউ জানে না।তার সন্তানরা নীরব সাক্ষী। হয়ত মেঘ আর আকাশ চুপি চুপি দেখেছে মায়ের কান্না। কিন্তু জানতে চায়নি কেন এ জল।বরং তারা বন্ধু হয়ে উঠেছে মায়ের।মনে মনে শপথ করেছে নিজেদেরকে নিজের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করার।হ্যা আজ রাই এর জীবনে সে দিন এসেছে।মেঘ আকাশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জনে চূড়ান্তভাবে সফল।একজন মা হিসাবে রাই তবুও কষ্ট পায়। কারন মেঘ আকাশকে সে আর সব বাচ্চার মত শৈশব দিতে পারেনি বলে।কি করে দিবে সন্তান আর সংসারকে সামাল দিতে একা রাইকে ছুটতে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে।কত রাত আকাশ মায়ের ঘরে ফেরার অপেক্ষাতে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাইয়ের সংসারে একজন পুরুষ মানুষ ছিল না কেবল।কিন্তু সংসারটা একছেলে একমেয়ে আর রাইয়ের সংসার।যদিও এ সমাজে স্বামী ছাড়া পরিবারকে সংসার মনে করে না।মেঘ আকাশ জানে কেন তাদের জীবনে বাবা শব্দটি হারিয়ে গেছে।তবে রাইয়ের আদেশ ছিল তাদের বাবা যেমন হোক সে তাদের বাবা।মায়ের মত বাবাকে শ্রদ্ধা করতে হবে।আর যার কাজের ফল সে ভোগ করবে।তার বিচারের দায় সন্তানদের নয়।সত্যি আজ তাদের বাবা সে ফল ভোগ করছে।সন্তানদের সফলতার অংশীদার সে হতে পারে না।অভাগা বাবা!

    ছুটে চলা জীবনের পথটা থমকে গেছে বলেই কি রাই আজ নিজেকে নিজে পড়ছে? সময়ের আগে অবসর এসে গেছে তার জীবনে।বাচ্চা দুটো ২৪ বছরে নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা বুঝে নিয়েছে।জীবনে চাকচিক্যময়ের প্রতি কোনদিনই মোহ ছিল না রাইয়ের।তাই হয়ত আজ আর ছুটে চলার তাগিদ নেই।সন্তানদের নিয়ে তার এখনো ভয় সব কিছু পেয়ে তারা ভুলে যাবে না তো মানুষ হবার শিক্ষাটা।

    চাওয়া পাওয়ার সীমিত গন্ডিতে যে জীবন সে দেখছে সেটা তার অনেক বড় উপলদ্ধি। একা নারী যখন পথ চলে সেখানে উপহাস পরিহাস যেমন থাকে তেমনি আছে মিথ্যা মায়া ভালোবাসার ছল।কণ্টকময় এ পথে যতটা সাবধানে পথ চলা যায় তত উত্তম। রাই শুধু এক নারী নয় সে মা। তার জীবনের ছায়া গিয়ে পড়বে সন্তানদের উপর।আর এ কারনে ভাবেনি নতুন কিছু। আসলে তেমন সময় কি ছিল রাইয়ের? আত্মীয় পরিজন কোনদিন তাকে নিয়ে ভাবেনি।কিংবা জানতেও চায়নি কেমন করে তাদের জীবন চলে।তবে বন্ধুদের অনেক বলত রাইয়ের জীবন কি করে কানাইয়া ছাড়া হয়।হয়ত সে অবতার নয় বলে এমনটা হয়েছে।

    ছেলে মেয়েদের জীবনের বদল হবে। মা হিসাবে এর জন্য প্রস্তুত রাই অনেক আগে থেকেই। আর সে কারনে রাই মেঘ আকাশকে বলত, আমার জন্য চিন্তা করবে না। তোমাদের বড় হতে হলে মায়ের কোল ছেড়ে বিদেশ যেতে হবে।ছেলে মেয়েরা যাবার সময় তার কষ্ট কেউ বুঝত না।কিন্তু ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ৩০ বছর আগের কান্না যে শুরু তা আজও থামেনি।শুধু প্রেক্ষিত বদল হচ্ছে।

    অনেক আনন্দের মাঝেও এখন বড্ড ক্লান্ত লাগে রাইয়ের।মনে হয়ে জীবনের সব তাড়া শেষ হয়ে গেল।বাঁচার আর কি কারন আছে?

    মনের ডায়েরীতে কিছু ঘটনা এখন বড় আবছা হয়ে গেছে। ৩০ বছর আগের কোন সুখ বা কষ্টতে তার মনে আবেগ আসে না।ভালোবাসা প্রেম - শব্দগুলো ভাবলেই চোখে ভেসে উঠে মেঘ আকাশের মুখ আর ঝরে পড়ে বেদনার নোনাজল।

    মায়ের একা থাকার কষ্ট শুনলে মেঘ আকাশ মুষড়ে পড়বে।এই ভেবে কোনদিন তাদের বলে না কিছু।কিন্তু আজ কেন বিশাল সাগর তার সবটুকু কান্নাকে উপড়ে নিচ্ছে। তবে কি এখন সে নিজের কাছে নিজে হেরে গেছে।নাকি জীবনের বাকীটা সময় নিয়ে শংকিত? এমন এলোমেলো ভাবনা কিসের অশনিসংকেত? যদি বিদায়ের ধ্বনি বেজে উঠে সে বিদায়ে তার কোন কষ্ট নেই আর। আকাশের তারা আর মেঘের বরষা হয়ে সে দূরে থেকে দেখবে তাদেরকে।মা হিসাবে অনেক কিছু দিতে পারেনি তার জন্য রাই ক্ষমা চাইছে বহুবার।তবে আবার জন্ম নিলে সে যেন আকাশ মেঘের মা হয় এটাই বলে প্রতিদিন।

    রাই আপন মনের ভাবনাতে এতটাই বিভোর ছিল যে রাই রাই বলে ডাকটাও শুনতে পায়নি।প্রদীপ একদম রাইয়ের সামনে এসে বলল,'তুমি রাই না'? আচমকা শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে রাই বলল,'তুমি'? রাইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রদীপ বলল, 'জি ম্যম আমি প্রদীপ, সেই প্রদীপ যে চুপি চুপি রাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত।কিন্তু রাই যখন জানল তখন ভেবেছে আমার পাগলামি।'

    রাই চোখের জল লুকাতে লুকাতে বলল,সত্যিই তো তুমি পাগল।এ বয়সে পাগলামি যায়নি দেখি। তা কি করে চিনলে আমাকে? এ কথাতে প্রদীপ কেমন যেন পালটে যায়।আর বলে, 'যেদিন আমি রাইকে চিনব না সেদিন যে আমার শেষ বিদায় হবে।'

    কথাটার সাথে যেন পিন পতন নিরবতা নেমে এল। কোন উত্তর খুঁজে পেল না রাই।প্রদীপই বলল ব্যস্ত জীবনের অবসানে কি চাইতে এলে সাগরের কাছ? ছেলে মেয়েরা তো তোমাকে গরবিনী মা করেছে।প্রদীপ গড়গড় করে বলে যাচ্ছে রাইয়ের দিনলিপি। আর রাই অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে প্রদীপের প্রেমকে পাগলামি ভেবে বাবার পছন্দের ছেলের সাথে সংসার করল সে কত কি ভাবে অত্যাচার করেছে।বাধ্য করল সংসার ছাড়তে। আর প্রদীপ তার সবটুকু জানে। কই সে তো জানে না প্রদীপের কিছু। জানতে চাইবে কি প্রদীপের সংসার সন্তানদের বিষয়।

    ঠিক তখনি প্রদীপ বলে সত্যিই বলে আকাশ, তাদের মা বড় বেশী ভাবুক।শুধু চিন্তা আর চিন্তা। রাই আরো অবাক হয়ে বলে, তুমি আকাশকে চিনো! কি করে? প্রদীপ হেসে উঠে বলে 'সিক্রেট 'বলা যাবে না।
    কথা কথা বলতে বলতে সাগর পাড়ের ছাতার নীচে বসে দুজন।বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে।রাই বলে, তোমার সংসার? হেসে প্রদীপ বলে,না রাই আমি পারিনি তোমার জায়গাটা কাউকে দিতে।রাই নিজের কান্নাকে আর সংবরণ করতে পারল না। এটা কি করে সম্ভব একজন পুরুষের দোষে সে সব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অথচ রাইয়ের জন্য এত ভালোবাসা আজও কারো আছে।

    প্রদীপকে তার সন্তানদের নিয়ে ৩০ বছরের কষ্ট যন্ত্রনা লড়াই সবটুকু বলতে বলতে টের ও পেলো না প্রদীপের চোখ থেকেও জল পড়ছে।
    রাই প্রদীপের কান্না দেখে বলে তুমি কেন কাঁদছ? প্রদীপ আপন মনে বলে, 'রাই ভালোবাসার কান্না তুমি বুঝতে চাওনি আর বুঝবে না।'

    আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে আছে মনে হয় ব্রষ্টি হবে। এমনটা দেখে রাই বলে উঠে আমার আকাশ মেঘ যদি এখন দেখত তবে বলত, আমাদের মা দেখি বড় ইমোশনাল।

    না প্রদীপ এ কথাতে হেসে উঠে না। বরং আরো সিরিয়াস হয়ে রাইয়ের হাত দুটো হাতে নিয়ে বলে, রাই বাকী জীবনের ক্লান্ত অবসরের সময়টুকু কি আমরা পারি না এক সাথে কাটাতে? অনেক কেঁদেছি এ জীবনে দুজন দুভাবে। এবার না হয় আমরা আমাদের জন্য বাঁচি।'

    রাই কেবল প্রদীপের দেখি বিস্ময় চেয়ে বলে, এত কিছু কি আমার পাবার ছিল দুনিয়াতে। তোমাকে দেবার মত কিছু তো নেই আমার।আছে কেবল আকাশ মেঘ। প্রদীপ বলে, আকাশ মেঘ আমাদের রাই।


Comments

1 comment